বারিমণ্ডল সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান খুবই সীমিত। পৃথিবীতে জনসংখ্যা দ্রুত হারে বাড়ছে এবং সম্পদের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। এর জন্য বারিমণ্ডলের প্রতি মানুষ আকৃষ্ট হচ্ছে। কারণ বারিমণ্ডলের তলদেশে বৈচিত্র্যপূর্ণ গঠন রয়েছে এবং সেখানে রয়েছে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ।
‘Hydrosphere'-এর বাংলা প্রতিশব্দ বারিমণ্ডল। ‘Hydro' শব্দের অর্থ পানি এবং 'Sphere' শব্দের অর্থ মণ্ডল। আমরা জানি পৃথিবীর সর্বত্র রয়েছে পানি। এ বিশাল জলরাশি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় থাকে যেমন— কঠিন (বরফ), গ্যাসীয় (জলীয়বাষ্প) এবং তরল। বায়ুমণ্ডলে পানি রয়েছে জলীয়বাষ্প হিসেবে, ভূপৃষ্ঠে রয়েছে তরল ও কঠিন অবস্থায় এবং ভূপৃষ্ঠের তলদেশে রয়েছে ভূগর্ভস্থ তরল পানি। সুতরাং বারিমণ্ডল বলতে বোঝায় পৃথিবীর সকল জলরাশির অবস্থানভিত্তিক বিস্তরণ (সারণি ১)। পৃথিবীর সকল জলরাশির শতকরা ৯৭ ভাগ পানি রয়েছে সমুদ্রে (মহাসাগর, সাগর ও উপসাগর)। মাত্র ৩ ভাগ পানি রয়েছে নদী, হিমবাহ, ভূগর্ভস্থ, হ্রদ, মৃত্তিকা, বায়ুমণ্ডল ও জীবমণ্ডলে। পৃথিবীর সমস্ত পানিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় যেমন— লবণাক্ত ও মিঠা পানি। পৃথিবীর সকল মহাসাগর, সাগর ও উপসাগরের জলরাশি লবণাক্ত এবং নদী, হ্রদ ও ভূগর্ভস্থ পানি মিঠা পানির উৎস।
সারণি ১ : জলরাশির অবস্থানভিত্তিক বিস্তরণ ও শতকরা হার
জলবিভাগের নাম |
পরিমাণ (ঘনকিলোমিটার × ১,০০,০০০) |
শতকরা হার (%) |
সমুদ্র | ১৩৭০ | ৯৭.২৫ |
হিমবাহ | ২৯ | ২.০৫ |
ভূগর্ভস্থ পানি | ৯.৫ | ০.৬৮ |
হ্রদ | ০.১২৫ | ০.০১ |
মাটির আর্দ্রতা | ০.০৬৫ | ০.০০৫ |
বায়ুমণ্ডল | ০.০১৩ | ০.০০১ |
নদী | ০.০০১৭ | ০.০০০১ |
জীবমণ্ডল | ০.০০০৬ | .০০০০০৪ |
মহাসাগর, সাগর ও উপসাগর
বারিমণ্ডলের উন্মুক্ত বিস্তীর্ণ বিশাল লবণাক্ত জলরাশিকে মহাসাগর (Ocean) বলে। পৃথিবীতে পাঁচটি মহাসাগর রয়েছে, এগুলো হলো প্রশান্ত মহাসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর, ভারত মহাসাগর, উত্তর মহাসাগর এবং দক্ষিণ মহাসাগর (চিত্র ৬.১)। এর মধ্যে প্রশান্ত মহাসাগর বৃহত্তম ও গভীরতম (সারণি ২)। আটলান্টিক মহাসাগর ভগ্ন উপকূলবিশিষ্ট এবং এটি অনেক আবদ্ধ সাগরের (Enclosed sea) সৃষ্টি করেছে। ভারত মহাসাগর এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত। ৬০° দক্ষিণ অক্ষাংশ থেকে এন্টার্কটিকার হিমভাগ পর্যন্ত দক্ষিণ মহাসাগরের অবস্থান। দক্ষিণ মহাসাগরের দক্ষিণে এন্টার্কটিকা মহাদেশ বছরের সকল সময় বরফে আচ্ছন্ন থাকে। উত্তর গোলার্ধের উত্তর প্রান্তে উত্তর মহাসাগর অবস্থিত এবং এর চারদিক স্থলবেষ্টিত।
সারণি ৩ : মহাসাগরের আয়তন ও গড় গভীরতা
মহাসাগর | আয়তন (বর্গকিলোমিটার) | গড় গভীরতা | অবস্থান |
প্রশান্ত মহাসাগর | ১৬ কোটি ৬০ লক্ষ | ৪,২৭০ | আমেরিকা ও এশিয়ার মধ্যবর্তী |
আটলান্টিক মহাসাগর | ৮ কোটি ২৪ লক্ষ | ৩,৯৩২ | আমেরিকা,ইউরোপ ও আফ্রিকা |
ভারত মহাসাগর | ৭ কোটি ৩৬ লক্ষ | ৩,৯৬২ | আফ্রিকা, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া |
উত্তর মহাসাগর | ১ কোটি ৫০ লক্ষ | ৮২৪ | পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ |
দক্ষিণ মহাসাগর | ১ কোটি ৪৭ লক্ষ | ১৪৯ | এন্টার্কটিকা ও ৬০° দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যবর্তী |
মহাসাগর অপেক্ষা স্বল্প আয়তনবিশিষ্ট জলরাশিকে সাগর (Sea) বলে। যথা- ভূমধ্যসাগর, লোহিত সাগর, ক্যরিবিয়ান সাগর, জাপান সাগর ইত্যাদি। তিনদিকে স্থলভাগ দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং একদিকে জল তাকে উপসাগর (Bay) বলে। যথা— বঙ্গোপসাগর, পারস্য উপসাগর ও মেক্সিকো উপসাগর ইত্যাদি। চারদিকে স্থলভাগ দ্বারা বেষ্টিত জলভাগকে হ্রদ (Lake) বলে। যথা— রাশিয়ার বৈকাল হ্রদ, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সীমান্তে অবস্থিত সুপিরিয়র হ্রদ ও আফ্রিকার ভিক্টোরিয়া হ্রদ ইত্যাদি।
কাজ : পৃথিবীর মানচিত্রে মহাসাগরের অবস্থান মানচিত্র নির্দেশক কাঠি দিয়ে ক্লাসের অন্যান্য সতীর্থদের দেখাও।
ভূপৃষ্ঠের উপরের ভূমিরূপ যেমন উঁচুনিচু তেমনি সমুদ্র তলদেশও অসমান। কারণ সমুদ্রতলে আগ্নেয়গিরি,
শৈলশিরা, উচ্চভূমি ও গভীর খাত প্রভৃতি বিদ্যমান আছে। শব্দতরঙ্গের সাহায্যে সমুদ্রের গভীরতা মাপা হয় ৷ এ শব্দতরঙ্গ প্রতি সেকেন্ডে পানির মধ্য দিয়ে প্রায় ১,৪৭৫ মিটার নিচে যায় এবং আবার ফিরে আসে। ফ্যাদোমিটার (Fathometer) যন্ত্রটি দিয়ে সমুদ্রের গভীরতা মাপা হয়। সমুদ্রের তলদেশের ভূমিরূপকে পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করা হয় (চিত্র ৬.২)। যথা—
(১) মহীসোপান (Continental shelf)
(২) মহীঢাল (Continental slope)
(৩) গভীর সমুদ্রের সমভূমি (Deep sea plains )
(৪) নিমজ্জিত শৈলশিরা (Oceanic ridges)
(৫) গভীর সমুদ্রখাত (Oceanic trench)
(১) মহীসোপান : পৃথিবীর মহাদেশসমূহের চারদিকে স্থলভাগের কিছু অংশ অল্প ঢালু হয়ে সমুদ্রের পানির মধ্যে নেমে গেছে। এরূপে সমুদ্রের উপকূলরেখা থেকে তলদেশ ক্রমনিম্ন নিমজ্জিত অংশকে মহীসোপান বলে। মহীসোপানের সমুদ্রের পানির সর্বোচ্চ গভীরতা ১৫০ মিটার। এটি ১° কোণে সমুদ্র তলদেশে নিমজ্জিত থাকে।মহীসোপানের গড় প্রশস্ততা কিলোমিটার। মহীসোপানের সবচেয়ে উপরের অংশকে উপকূলীয় ঢাল বলে। মহীসোপানের বিস্তৃতি সর্বত্র সমান নয়। উপকূলভাগের বন্ধুরতার উপর এর ২,০০০ থেকে ৩,০০০ মিটার বিস্তৃতি নির্ভর করে। উপকূল যদি বিস্তৃত সমভূমি হয়, তবে মহীসোপান অধিক ৪,০০০ থেকে ৬,০০০ মিটার প্রশস্ত হয়। মহাদেশের উপকূলে পর্বত বা মালভূমি থাকলে মহীসোপান সংকীর্ণ হয়। ইউরোপের উত্তরে বিস্তীর্ণ সমভূমি ১০,০০০ মিটার থাকায় উত্তর মহাসাগরের মহীসোপান খুবই প্রশস্ত (প্রায় ১,২৮৭ কিলোমিটার)। তবে ইউরোপের উত্তর-পশ্চিমে পৃথিবীর বৃহত্তম মহীসোপান অবস্থিত। মহীসোপানের দ্বিতীয় বৃহত্তম অংশ উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলে দেখতে পাওয়া যায়। অথচ এর পশ্চিমে উপকূল বরাবর উত্তর-দক্ষিণ ভঙ্গিল রকি পর্বত অবস্থান করায় সেখানে মহীসোপান খুবই সংকীর্ণ। আফ্রিকা মহাদেশের অধিকাংশ স্থান মালভূমি বলে এর পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের মহীসোপান খুবই সরু।
স্থলভাগের উপকূলীয় অঞ্চল নিমজ্জিত হওয়ার ফলে অথবা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার তারতম্য হওয়ার কারণে মহীসোপানের সৃষ্টি হয়। এছাড়া সমুদ্রতটে সমুদ্রতরঙ্গও ক্ষয়ক্রিয়ার দ্বারা মহীসোপান গঠনে সহায়তা করে থাকে।
(২) মহীঢাল : মহীসোপানের শেষ সীমা থেকে ভূভাগ হঠাৎ খাড়াভাবে নেমে সমুদ্রের গভীর তলদেশের সঙ্গে মিশে যায়। এ ঢালু অংশকে মহীঢাল বলে। সমুদ্রে এর গভীরতা ২০০ থেকে ৩,০০০ মিটার। সমুদ্র তলদেশের এ অংশ অধিক খাড়া হওয়ার জন্য প্রশস্ত কম হয়। এটি গড়ে প্রায় ১৬ থেকে ৩২ কিলোমিটার প্রশস্ত । মহীঢালের উপরিভাগ সমান নয়। অসংখ্য আন্তঃসাগরীয় গিরিখাত অবস্থান করায় তা খুবই বন্ধুর প্রকৃতির। এর ঢাল মৃদু হলে জীবজন্তুর দেহাবশেষ, পলি প্রভৃতির অবক্ষেপণ দেখা যায়।
(৩) গভীর সমুদ্রের সমভূমি : মহীঢাল শেষ হওয়ার পর থেকে সমুদ্র তলদেশে যে বিস্তৃত সমভূমি দেখা যায় তাকে গভীর সমুদ্রের সমভূমি বলে। এর গড় গভীরতা ৫,০০০ মিটার। এ অঞ্চলটি সমভূমি নামে খ্যাত হলেও প্রকৃতপক্ষে তা বন্ধুর। কারণ গভীর সমুদ্রের সমভূমির উপর জলমগ্ন বহু শৈলশিরা ও উচ্চভূমি অবস্থান করে। আবার কোথাও রয়েছে নানা ধরনের আগ্নেয়গিরি। এ সমস্ত উচ্চভূমির কোনো কোনোটি আবার জলরাশির উপর দ্বীপরূপে অবস্থান করে। সমুদ্রের এ গভীর অংশে পলিমাটি ও সিন্ধুমল এবং আগ্নেয়গিরি থেকে উত্থিত লাভা ও সূক্ষ্ম ভস্ম প্রভৃতি সঞ্চিত হয়। এ সকল সঞ্চিত পদার্থ স্তরে স্তরে জমা হয়ে পাললিক শিলার সৃষ্টি করে ।
(৪) নিমজ্জিত শৈলশিরা : সমুদ্রের অভ্যন্তরে অনেকগুলো আগ্নেয়গিরি অবস্থান করছে। ঐসব আগ্নেয়গিরি থেকে লাভা বেরিয়ে এসে সমুদ্রগর্ভে সঞ্চিত হয়ে শৈলশিরার ন্যায় ভূমিরূপ গঠন করেছে। এগুলোই নিমজ্জিত শৈলশিরা নামে পরিচিত। নিমজ্জিত শৈলশিরাগুলোর মধ্যে মধ্য আটলান্টিক শৈলশিরা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
(৫) গভীর সমুদ্রখাত : গভীর সমুদ্রের সমভূমি অঞ্চলের মাঝে মাঝে গভীর খাত দেখা যায়। এ সকল খাতকে গভীর সমুদ্রখাত বলে। পাশাপাশি অবস্থিত মহাদেশীয় ও সামুদ্রিক প্লেট সংঘর্ষের ফলে সমুদ্রখাত প্লেট সীমানায় অবস্থিত। এ প্লেট সীমানায় ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরি অধিক হয় বলেই এ সকল খাত সৃষ্টি হয়েছে। এ খাতগুলো অধিক প্রশস্ত না হলেও খাড়া ঢালবিশিষ্ট। এদের গভীরতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫,৪০০ মিটারের অধিক।
প্রশান্ত মহাসাগরেই গভীর সমুদ্রখাতের সংখ্যা অধিক। এর অধিকাংশই পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। এ সকল গভীর সমুদ্রখাতের মধ্যে গুয়াম দ্বীপের ৩২২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ম্যারিয়ানা খাত (Mariana trench) সর্বাপেক্ষা গভীর। এর গভীরতা প্রায় ১০,৮৭০ মিটার এবং এটাই পৃথিবীর গভীরতম খাত। এছাড়া আটলান্টিক মহাসাগরের পোর্টোরিকো খাত (৮,৫৩৮ মিটার) এবং ভারত মহাসাগরের শুন্ডা খাত প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ।
কাজ : দলগতভাবে নিচের ছকে বৈশিষ্টগুলো লেখ ।
মহীসোপান | মহীঢাল | গভীর সমুদ্রের সমভূমি | নিমজ্জিত শৈলশিরা | গভীর সমুদ্রখাত |
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
সমুদ্রস্রোতের প্রধান কারণ বায়ুপ্রবাহ। বায়ুপ্রবাহ সমুদ্রের উপরিভাগের পানির সঙ্গে ঘর্ষণ (Friction) তৈরি করে এবং ঘর্ষণের জন্য পানিতে ঘূর্ণন (Gyre/ spiral pattern) তৈরি করে। সমুদ্রের পানি একটি নির্দিষ্ট গতিপথ অনুসরণ করে চলাচল করে, একে সমুদ্রস্রোত বলে।
সমুদ্রস্রোতকে উষ্ণতার তারতম্য অনুসারে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা— (ক) উষ্ণ স্রোত ও (খ) শীতল স্রোত (চিত্র ৬.৩)।
(ক) উষ্ণ স্রোত : নিরক্ষীয় অঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি হওয়ায় জলরাশি হালকা হয় ও হালকা জলরাশি সমুদ্রের উপরিভাগ দিয়ে পৃষ্ঠপ্রবাহরূপে শীতল মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়। এরূপ স্রোতকে উষ্ণ স্রোত (Warm currents) বলে।
(খ) শীতল স্রোত : মেরু অঞ্চলের শীতল ও ভারী জলরাশি জলের নিচের অংশ দিয়ে অন্তঃপ্রবাহরূপে নিরক্ষীয় উষ্ণমণ্ডলের দিকে প্রবাহিত হয়। এরূপ স্রোতকে শীতল স্রোত (Cold currents) বলে।
সমুদ্রস্রোতের কারণ (Causes of ocean currents)
১। নিয়ত বায়ুপ্রবাহ : নিয়ত বায়ুপ্রবাহই সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির প্রধান কারণ। এসব বায়ুপ্রবাহ সমুদ্রস্রোতের দিক ও গতি নিয়ন্ত্রণ করে। অয়ন বায়ু, পশ্চিমা বায়ু ও মেরু বায়ুর প্রবাহ অনুযায়ী প্রধান সমুদ্রস্রোতগুলোর সৃষ্টি হয় (চিত্র ৬.৪)।
২। পৃথিবীর আহ্নিক গতি : পৃথিবীর আহ্নিক গতির ফলে ফেরেলের সূত্র অনুসারে বায়ুপ্রবাহের মতো সমুদ্রজলও উত্তর গোলার্ধে ডান দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বাম দিকে বেঁকে যায়। এর ফলে সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয়।
৩। সমুদ্রজলের তাপমাত্রার পার্থক্য : নিরক্ষীয় অঞ্চলে উষ্ণমণ্ডলের সমুদ্রের জল বেশি উষ্ণ বলে তা জলের উপরের অংশ দিয়ে পৃষ্ঠপ্রবাহ বা বহিঃস্রোতরূপে মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়। অন্যদিকে মেরু অঞ্চল থেকে শীতল ও ভারী জলরাশি জলের নিচের অংশ দিয়ে অন্তঃপ্রবাহ বা অন্তঃস্রোতরূপে নিরক্ষীয় উষ্ণমণ্ডলের দিকে প্রবাহিত হয়। এইভাবে উষ্ণ ও শীতল সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয়।
৪। মেরু অঞ্চলের সমুদ্রে বরফের গলন : মেরু অঞ্চলের সমুদ্রে বরফ কিছু পরিমাণ গলে গেলে জলরাশি স্ফীত হয় ও সমুদ্রজলের লবণাক্ততার পরিমাণ হ্রাস পায়। এর ফলে সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয় ।
৫। সমুদ্রের গভীরতার তারতম্য : সমুদ্রের গভীরতার তারতম্য অনুসারে তাপমাত্রার পার্থক্য হয়। অগভীর সমুদ্রের জল দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে উপরে ওঠে। তখন গভীরতর অংশের শীতল জল নিচে নেমে আসে। এজন্য ঊর্ধ্বগামী ও নিম্নগামী সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয়। সমুদ্রের পৃষ্ঠে গতি সবচেয়ে বেশি। সমুদ্রের ১০০ মিটার নিচ থেকে গতি কমতে থাকে।
৬। সমুদ্রজলের লবণাক্ততার পার্থক্য : সমুদ্রজলে লবণের পরিমাণ সর্বত্র সমান নয়। অধিক লবণাক্ত জল বেশি ভারী বলে তার ঘনত্বও বেশি। বেশি ঘনত্বের জল কম ঘনত্বের দিকে নিম্ন প্রবাহরূপে প্রবাহিত হয় ও ও সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি করে।
৭। ভূখণ্ডের অবস্থান : সমুদ্রস্রোতের প্রবাহপথে কোনো মহাদেশ, দ্বীপ প্রভৃতি ভূখণ্ড অবস্থান করলে সমুদ্রস্রোত তাতে বাধা পেয়ে দিক ও গতিপথ পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। অনেক সময় এর প্রভাবে সমুদ্রস্রোত একাধিক শাখায় বিভক্ত হয়।
সমুদ্রস্রোতের প্রভাব (Influence of ocean currents )
নানাবিধ কারণে সমুদ্রস্রোতের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে এলাকার উপর দিয়ে সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হয় সেখানে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকার জলবায়ু এবং বাণিজ্যের উপর সমুদ্রস্রোতের প্রভাব অত্যধিক।
বায়ুপ্রবাহ সমুদ্রের উপরিভাগে স্রোত তৈরি করে নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে মেরু অঞ্চলে যায় । |
মেরু অঞ্চলের ঠান্ডা ভারী পানি নিম্নগামী (Sink) হয় (অন্তঃস্রোত)।
যেহেতু উপরে পানি সরে যায়, তাই নিচের পানি উপরের দিকে উঠে যায় (Upwelling) ও এর স্থান দখল করে। |
প্রবাহচিত্র : সমুদ্রের উপরের (Surface) এবং নিমজ্জিত (Deep) স্রোত একসঙ্গে সঞ্চালন স্রোত (Convection current) তৈরি করে, যার ফলে সমুদ্রের জলরাশি একস্থান থেকে অন্যস্থানে প্রবাহিত হয় ।
১। উষ্ণ সমুদ্রস্রোতের প্রভাব : উষ্ণ সমুদ্রস্রোতের প্রভাবে কোনো অঞ্চলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। তাই শীতল অঞ্চলের উপর দিয়ে উষ্ণ স্রোত প্রবাহিত হলে শীতকালেও বরফ জমতে পারে না। বন্দরগুলো সারাবছর ব্যবহার করা যায়। যেমন— উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের প্রভাবে নরওয়ে ও ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিম উপকূল শীতকালে বরফমুক্ত থাকে, কিন্তু একই অক্ষাংশে অবস্থিত কানাডার পূর্ব উপকূলে বরফাচ্ছন্ন অবস্থা দেখা যায় ।
২। শীতল সমুদ্রস্রোতের প্রভাব : শীতল সমুদ্রস্রোতের প্রভাবে কোনো অঞ্চলের শীতলতা বৃদ্ধি পায়। যেমন— শীতল ল্যাব্রাডর স্রোতের প্রভাবে কানাডার পূর্ব উপকূলে ল্যাব্রাডর দ্বীপপুঞ্জের নিকটবর্তী অঞ্চল সারাবছর বরফাচ্ছন্ন থাকে। একই কারণে শীতল কামচাটকা স্রোতের প্রভাবে এশিয়ার পূর্ব উপকূলে কামচাটকা উপদ্বীপের শীতলতা বৃদ্ধি পায়।
৩। পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর প্রভাব : সমুদ্রস্রোতের অনুকূলে নৌকা, জাহাজ প্রভৃতি চলাচলের সুবিধা হয়। তবে শীতল সমুদ্রস্রোত অপেক্ষা উষ্ণ সমুদ্রস্রোতে জাহাজ ও নৌচলাচলের সুবিধা বেশি। উত্তর আটলান্টিক সমুদ্রস্রোতের অনুকূলে পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক জাহাজ যাতায়াত করে। শীতল স্রোতের গতিপথে তীব্র শীত ও হিমশৈলের জন্য জাহাজ চলাচলের অসুবিধা দেখা যায় ।
৪। আবহাওয়ার উপর প্রভাব : উষ্ণ সমুদ্রস্রোতের উপর দিয়ে প্রবাহিত হলে বায়ুপ্রবাহ প্রচুর পরিমাণে জলীয়বাষ্প সংগ্রহ করে। এই উষ্ণ বায়ুর প্রভাবে উপকূল অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। যেমন— উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের উপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ু ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিম উপকূলে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায় । অপরদিকে শীতল সমুদ্রস্রোতের উপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ু শুষ্ক বলে বৃষ্টিপাত ঘটায় না। যেমন— কখনো শীতল মরুভূমির সৃষ্টি করে। দক্ষিণ আমেরিকার আতাকামা মরুভূমি শীতল পেরু স্রোত-এর দ্বারা প্রভাবিত হয় ।
৫। কুয়াশা ও ঝড়ঝঞ্ঝা সৃষ্টি : উষ্ণ ও শীতল স্রোতের মিলন অঞ্চলে অল্প স্থানব্যাপী উষ্ণতার ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়। এই অঞ্চলে ঘন কুয়াশা ও ঘূর্ণিবাতের সৃষ্টির ফলে প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝার সৃষ্টি হয়। জাহাজ ও বিমান চলাচলে অসুবিধা দেখা দেয়। যেমন— উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলে শীতল ল্যাব্রাডর স্রোত ও উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের মিলনের ফলে এবং এশিয়ার উপকূলে শীতল কামচাটকা স্রোত ও বেরিং স্রোত এবং উষ্ণ জাপান স্রোতের মিলনের ফলে এরূপ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সৃষ্টি হয় ।
৬। সমুদ্রে অগভীর মগ্নচড়ার সৃষ্টি : উষ্ণ ও শীতল স্রোতের মিলন স্থলে শীতল স্রোতের সঙ্গে বাহিত বড় বড় হিমশৈল উষ্ণ স্রোতের প্রভাবে গলে যায়। ফলে হিমশৈলের মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন নুড়ি, কাঁকর, বালি প্রভৃতি সমুদ্রতলে সঞ্চিত হয় এবং একসময় মগ্নচড়ার সৃষ্টি করে। নিউফাউন্ডল্যান্ডের উপকূলে গ্র্যান্ড ব্যাঙ্ক ও সেবল ব্যাঙ্ক এবং ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের উপকূলে ডগার্স ব্যাঙ্ক এগুলো মগ্নচড়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
৭। মৎস্য ব্যবসার সুবিধা : অগভীর মগ্নচড়াগুলোতে প্রচুর পরিমাণে প্ল্যাংকটন (একপ্রকার অতি ক্ষুদ্র উদ্ভিদ ও প্রাণী) জন্মায় ও বংশবৃদ্ধি করে। এই প্ল্যাংকটন মাছের অতি প্রিয় খাদ্য। এই মগ্নচড়াগুলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মাছ আহরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। নিউফাউন্ডল্যান্ডের উপকূল ও জাপান উপকূলে পৃথিবীর অধিকাংশ মাছ ধরা হয়।
৮। হিমশৈলের আঘাতে বিপদ : শীতল সমুদ্রস্রোতের সঙ্গে যেসব হিমশৈল ( Iceberg) ভেসে আসে সেগুলোর কারণে জাহাজ চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়। অনেক সময় হিমশৈলের সঙ্গে ধাক্কা লেগে জাহাজডুবির ঘটনা ঘটে। যেমন— যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত টাইটানিক জাহাজ ১৯১২ সালে প্রথম যাত্রাতেই হিমশৈলের সঙ্গে ধাক্কা লেগে সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিল।
প্রধানত দুটি কারণে জোয়ার-ভাটার সৃষ্টি হয়। এগুলো হলো— (১) চাঁদ ও সূর্যের মহাকর্ষ শক্তির প্রভাব এবং (২) পৃথিবীর আবর্তনের ফলে উৎপন্ন কেন্দ্রাতিগ শক্তি।
(১) চাঁদ ও সূর্যের মহাকর্ষ শক্তির প্রভাব : মহাকর্ষ সূত্র অনুযায়ী মহাকাশে বিভিন্ন গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র প্রভৃতি প্রতিটি জ্যোতিষ্ক পরস্পরকে আকর্ষণ করে। তাই এর প্রভাবে সূর্য ও চাঁদ পৃথিবীকে আকর্ষণ করে। কিন্তু পৃথিবীর উপর সূর্য অপেক্ষা চাঁদের আকর্ষণ বল বেশি হয়। কারণ সূর্যের ভর অপেক্ষা চাঁদের ভর অনেক কম হলেও চাঁদ সূর্য অপেক্ষা পৃথিবীর অনেক
জোয়ার ও ভাটা (High Tide and Low Tide) : সমুদ্র এবং উপকূলবর্তী নদীর জলরাশি প্রতিদিনই কোনো একটি সময়ে ঐ জলরাশি ধীরে ধীরে ফুলে উঠছে এবং কিছুক্ষণ পরে আবার তা ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে। জলরাশির এরকম নিয়মিত স্ফীতি এবং ফুলে ওঠাকে জোয়ার এবং নেমে যাওয়াকে ভাটা বলে। মহাকর্ষ (Gravitional) : এ মহাবিশ্বের প্রত্যেকটি বস্তুকণাই একে অপরকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে। এ মহাবিশ্বের যে কোনো দুটি বস্তুর মধ্যে যে আকর্ষণ তাকে মহাকর্ষ বলে। |
নিকটে অবস্থিত। তাই সমুদ্রের জল তরল বলে চাঁদের আকর্ষণেই প্রধানত সমুদ্রের জল ফুলে ওঠে ও জোয়ার হয়। সূর্যের আকর্ষণে জোয়ার তত জোরালো হয় না। চাঁদ ও সূর্য একই সরলরেখায় অবস্থিত হলে চাঁদ ও সূর্য উভয়ের আকর্ষণে জোয়ার অত্যন্ত প্রবল হয়।
(২) পৃথিবীর আবর্তনের ফলে উৎপন্ন কেন্দ্রাতিগ শক্তি : পৃথিবী নিজ মেরুরেখার চারদিকে অনবরত আবর্তন করে বলে কেন্দ্রাতিগ শক্তি বা বিকর্ষণ শক্তির সৃষ্টি হয়। এই কেন্দ্রাতিগ শক্তির প্রভাবে পৃথিবীর প্রতিটি অণুই মহাকর্ষ শক্তির বিপরীত দিকে বিকর্ষিত হয় বা ছিটকে যায়। তাই পৃথিবীর কেন্দ্রাতিগ শক্তির প্রভাবে যেখানে মহাশক্তির প্রভাবে জোয়ারের সৃষ্টি হয়, তার বিপরীত দিকে সমুদ্রের জল বিক্ষিপ্ত হয়েও জোয়ারের সৃষ্টি করে (চিত্র ৬.৫)।
মানব-জীবনের উপর জোয়ার-ভাটার যথেষ্ট প্রভাব আছে। বিশ্বের সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশসমূহে জোয়ার- ভাটার নিম্নের প্রভাবসমূহ লক্ষ করা যায়।
১। জোয়ার-ভাটার মাধ্যমে ভূখণ্ড থেকে আবর্জনাসমূহ নদীর মধ্য দিয়ে সমুদ্রে গিয়ে পতিত হয়।
২। দৈনিক দু'বার জোয়ার-ভাটা হওয়ার ফলে ভাটার টানে নদীর মোহনায় পলি ও আবর্জনা জমতে পারে না।
৩। জোয়ার-ভাটার ফলে সৃষ্ট স্রোতের সাহায্যে নদীখাত গভীর হয়।
৪। বহু নদীতে ভাটার স্রোতের বিপরীতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ (Hydroelectricity) উৎপাদন করা হয়। ৫। জোয়ারের পানি নদীর মাধ্যমে সেচে সহায়তা করে এবং অনেক সময় খাল খনন করে জোয়ারের পানি আটকিয়ে সেচকার্যে ব্যবহার করা হয়।
৬। শীতপ্রধান দেশে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি জোয়ারের সাহায্যে নদীতে প্রবেশ করে এবং এর ফলে নদীর পানি সহজে জমে না ।
৭। জোয়ার-ভাটার ফলে নৌযান চলাচলের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা হয়। জোয়ারের সময় নদীর মোহনায় ও তার অভ্যন্তরে পানি অধিক হয় বলে বড় বড় সমুদ্রগামী জাহাজের পক্ষে নদীতে প্রবেশ করা সুবিধা হয়। আবার জোয়ারের টানে ঐ জাহাজ অনায়াসে সমুদ্রে নেমে আসতে পারে। বাংলাদেশের দুটি প্রধান সমুদ্রবন্দর পতেঙ্গা ও মংলা এবং অন্যান্য উপকূলবর্তী নদীবন্দর সচল রাখতে জোয়ার-ভাটার ভূমিকা রয়েছে।
৮। অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে নদীতে অধিক মাত্রায় জোয়ারের সময় নৌকা, লঞ্চ প্রভৃতি ডুবে যায় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এতে নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকায় জানমালের ক্ষতি হয়। এই অধিক জোয়ারে নদীর সংকীর্ণ মোহনায় শব্দতরঙ্গ সৃষ্টি হলে একে জোয়ারের বান বলে।
বাংলাদেশের প্রায় ৭১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চলের বঙ্গোপসাগরে রয়েছে অনেক সামুদ্রিক সম্পদ। এর সমুদ্র তলদেশে ৪৪২ প্রজাতির মৎস্য, ৩৩৬ প্রজাতির মলাস্কস (Mollusks), ১৯ প্রজাতির চিংড়ি, নানারকম কাঁকড়া এবং ম্যানগ্রোভ বনসহ আরও বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক জলজ উদ্ভিদ। কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকায় পারমাণবিক খনিজ জিরকন, মোনাজাইট, ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, রিওটাইল ও লিউকক্সেন পাওয়া গেছে। এছাড়া সমুদ্র তলদেশে রয়েছে খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদ।
আরও দেখুন...